আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে-বিপক্ষে নই, ইসলামের পক্ষে -এ এম এম বাহাউদ্দীন
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ দেশে নীতি নৈতিকতা মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংসের অপচেষ্টা চলছে অভিযোগ করে মাদরাসার শিক্ষক ও আলেম সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলার আহবান জানিয়েছেন মাদরাসা শিক্ষকদের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি ও দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীন। তিনি বলেছেন, জমিয়াতুল মোদার্রেছীন অরাজনৈতিক সংগঠন। এ সংগঠন সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে- বিপক্ষে নয়, আমরা ইসলামের পক্ষে। ইসলামী মূল্যবোধের ওপর আঘাত হলে প্রতিবাদ করবোই। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালীস্থ গাউসুল আজম কমপ্লেক্সে ঈসালে সাওয়াব ও দোয়া মাহফিলে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সাবেক সভাপতি, উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, সাবেক ধর্ম ও ত্রাণমন্ত্রী এবং দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর ১৮তম ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে এই ঈসালে সাওয়াব ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে সংগঠনটি। একই সঙ্গে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভাও অনুষ্ঠিত হয়।
এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, সাংস্কৃতির আগ্রাসনের মাধ্যমে দেশকে অপসংস্কৃতি চর্চার চারণভূমি বানানোর অপচেষ্টা চলছে। দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিনষ্টের অপচেষ্টা অনেক আগে থেকেই ছিল। এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে মোদি (ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি) সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৯২ ভাগ মুসলমানের এই বাংলাদেশে তারা (হিন্দত্ববাদ) তাদের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা বলিষ্ট করার জন্য কিছু লোক সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মূল অনুভূতি আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরেও হচ্ছে ইসলামী মূল্যবোধ। রাজনৈতিকভাবে কে কাকে ভোট দিলো সেটি ভিন্ন বিষয়, কিন্তু ইসলামী মূল্যবোধের জায়গায় আমরা সকলে একমত। এই মূল্যবোধকে ধ্বংস করার চেষ্টায় কোন লাভ হবে না। ঐক্যবদ্ধ ভাবে রুখে দিতে হবে।
বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট এবং মুসলমানদের সাফল্যের চিত্র তুলে ধরে সভাপতির বক্তৃতায় আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানী ও জাপানকে ধ্বংস করা জন্য আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপ রাশিয়াকে নিয়ে জোট করে। এখন আবার রাশিয়াকে ধ্বংস করার জন্য আমেরিকা, জার্মানী, জাপান ব্রিটেন এক হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সমীকরণ কখনো এক থাকে না। নানাবিধ কারণে একেকজন একেকদিকে যায়। কিন্তু শক্তিমানদের শক্তির চিন্তা এক থাকে। জমিয়াতুল মোদার্রেছীন আল্লাহর রহমানে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি সংগঠন। জমিয়াতুল মোদার্রেছীন একটি গণতান্ত্রিক সংগঠন। প্রত্যেক সদস্যের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট রয়েছে। কিন্তু পৃথকভাবে কারো কোন ক্ষমতা নেই। ঐক্যবদ্ধ থাকলে সকলেই শক্তিশালী। তিনি আরো বলেন, জমিয়াতুল মোদার্রেছীন কোন রাজনৈতিক সংগঠন নয়, এ সংগঠন সরকারের বিরুদ্ধেও না, সরকারের পক্ষেও না। আমরা ইসলামের সপক্ষে। জমিয়াতুল মোদার্রেছীন নিয়ে কোন ধরণের সন্দেহ ও সংশয় থাকার সুযোগ নেই। কারণ আল্লাহর রহমতে এই সংগঠন অত্যন্ত শক্তিশালী। এটি কারো ব্যক্তিগত সংগঠন নয়, এটি সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার ওলী, সূফীদের সংগঠন। কেউ থাকুক আর না থাকুক জমিয়াতুল মোদার্রেছীন থাকবে ইন শা আল্লাহ। অন্য কোন চিন্তায় বা বিভ্রান্তিতে এটি অসম্মানিত হবে না।
দেশের আলেম সমাজ ও মাদরাসা শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে ইনকিলাব সম্পাদক বলেন, এটা ডিজিটালের যুগ। বিজ্ঞানের বদৌলতে সবকিছু এখন সহজলভ্য। আপনাদের পেছনে যে ৭০ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে তারা সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত আছেন। আমরা (আলেম সমাজ ও শিক্ষক) কি করি, কি বলি, আর শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা কি চিন্তা করছে সেটি আমাদের ভাবতে হবে। তাদের যদি বোঝাতে না পারি তাহলে কোন কিছু হবে না। তিনি বলেন, আজকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসিফ মাহতাব নামে একটা ছেলে শরীফ-শরীফার গল্প নিয়ে একাই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মাদরাসা শিক্ষকরা কেন এসব বিষয়ে কথা বলার সাহস রাখেননি। কারণ চাকরি আর বেতন-ভাতা নিয়ে চিন্তা করেন। বেতন-ভাতা নিয়ে কেন এতো কথা বলবেন? এদেশে মাদরাসা কি বেতন-ভাতা, সুবিধার জন্য সুফী, দরবেশরা তৈরি করেছিল?
ইনকিলাব সম্পাদক বলেন, মেইন স্ট্রিম কথা না বললে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাভাবে কথা উঠবে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের উস্কে দেয়া হবে। তখন কারো হাতে কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এজন্য সকলে ঈমান মজবুত রাখতে হবে। পয়সা কামানোর জন্য যদি চাকরি করতে হয় তাহলে মাদরাসায় কেন? এর বাইরেও অনেক পেশা আছে।
বিজ্ঞান শিক্ষায় অগ্রগতির গুরুত্ব তুলে ধরে এএমএম বাহাউদ্দীন বলেন, মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক করতে হলে বিজ্ঞানে উন্নতি করতে হবে। এখন ইলেন মাস্ক মানুষের মস্তিষ্কে চিপ বসিয়ে চিন্তা-চেতনা নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবছে, বিজ্ঞানীরা চাঁদ, মঙ্গল গ্রহসহ অন্যান্য গ্রহে বসবাস করা যায় কিভাবে সেটি নিয়ে ভাবছে। ব্ল্যাক হোল নিয়ে আলেমদের কোন গবেষণা নিয়ে, কথা বলা, আলোচনা করা হয় না। আমাদের আলেমগণ ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, মালয়েশিয়াসহ যেসব দেশে যেতে হবে, তারা কিভাবে বিজ্ঞানে অগ্রগামী হয়েছে, ইসলামী চিন্তা-চেতনা কিভাবে ঠিক রেখেছে সেটি বুঝতে হবে। যেসব দেশ ইসলামী ধ্যান-ধারণা ঠিক রাখছে তাদেরকে আল্লাহ সম্পদে বলিয়ান করেছে। আর আমাদের এখানে খরা হচ্ছে। ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বিজ্ঞান ও ইসলামী ধ্যান-ধারা আরো বেশি করে চর্চা করতে হবে।
মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে আধুনিক তুরস্ক গড়ে উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাদরাসা পড়ুয়া তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মন্ত্রীসভায় এখন অধিকাংশ সদস্য এখন মাদরাসা পড়ুয়া। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক যে মাদরাসা সিস্টেম করেছিলেন সেটি আরো আধুনিক করেছে এবং নতুন তুরস্ক করে গড়ে তুলছে। তার নেতৃত্বে দিনে দিনে আরো শক্তিশালী হচ্ছে তুরস্ক।
তিনি আরো বলেন, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল নেতা হওয়ার খায়েশে। সউদী আরবের উগ্র চিন্তা-চেতনার বাদশা বা সেখানকার ভেতরের আলেম-ওলামাগণ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। সেটা কিন্তু এখন হাওয়া হয়ে গেছে। তার প্রভাবও আমাদের দেশেও পড়েছিল এখন অনেকের ফান্ড বন্ধ হয়ে গেছে।
পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর অনুধাবনকে সাধুবাদ জানিয়ে জমিয়াত সভাপতি বলেন, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী উপমন্ত্রী থেকে সরাসরি মন্ত্রী হয়েছে। এর মাধ্যমে আল্লাহতাআলা তাকে সম্মানিত করেছেন। তিনি লন্ডন থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। উনার (শিক্ষামন্ত্রী) পিতা মহিউদ্দীন চৌধুরী সাহেব জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। একইসঙ্গে আলেম-ওলামাদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক সব সময় রাখতেন। আমি বিশ্বাস করি, উনি (শিক্ষামন্ত্রী) উনার বাবার মতোই চিন্তা-চেতনা লালন করবেন। কারণ ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছি, পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম নিয়ে তিনি সতর্ক অবজারভেশন দিয়েছেন। তার কথারই পুনরাবৃত্তি আমরা দেখেছি প্রধানমন্ত্রীর কথাতেও। পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এদিকে যাদের মাধ্যমে আমরা ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছি, সেই সময়ের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হয়েছেন এবং সেই সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ছিলেন কামাল আবদুল নাসের সাহেব উনি এখন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা হয়েছেন। তাদের হাত দিয়েই প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। উনাদের সঙ্গে আলেম-ওলামাদের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং এখন আরো দৃঢ় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যেই ধারায় চিন্তা করেন এবং নিয়ে যেতে যান সেই ধারা থেকে হয়তো বিচ্যুত হয়েছে এজন্য নতুন শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষামন্ত্রীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ক্ষমতার জন্য ভারতের সঙ্গে অনেক সহযোগিতা করতে হয়। এটি করতে গিয়ে দেখা যায় যে, নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি হয়ে যায়। সরকারেরও অনেক সঙ্কট আছে।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব প্রিন্সিপাল মাওলানা শাব্বির আহমদ মোমতাজীর পরিচালনায় এসময় স্ট্যান্ডিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে জাতীয় নির্বাহী কমিটি। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন- জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা কবি রূহুল আমীন খান, মুশুরীখোলা দরবারের পীর আল্লামা মাওলানা আহসানুজ্জামান, জৈনপুরের পীর সাহেব মাওলানা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, প্রিন্সিপাল মাওলানা খলিলুর রহমান নেছারাবাদী, মাওলানা ক্বারী হাবিবুল্লাহ বেলালী, কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা ড. এ কে এম মাহবুবুর রহমান (চাঁদপুর), প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক (ঢাকা), প্রিন্সিপাল মাওলানা ড. নজরুল ইসলাম আল-মারুফ (ঢাকা), প্রিন্সিপাল মাওলানা ড. সৈয়দ শরাফত আলী (পিরোজপুর), প্রিন্সিপাল মাওলানা আ খ ম আবুবকর সিদ্দিক (ঢাকা), প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল ফরাহ্ মোঃ ফরিদ উদ্দিন (চট্টগ্রাম), প্রিন্সিপাল মাওলানা মনোওর আলী (সিলেট), মুর্শীদ নগর দরবারের পীর প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল হাকীম জেহাদী, ড. আব্দুল কাইয়ুম আল-আজহারী (ঢাকা), প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল বয়ান হাশেমী (চট্টগ্রাম), ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা নুরুল ইসলাম (যশোর), প্রিন্সিপাল মাওলানা হাসান মাসুদ (দিনাজপুর), প্রিন্সিপাল মাওলানা জহিরুল হক (গাজীপুর), প্রিন্সিপাল মাওলানা হাদিউজ্জামান (রংপুর), প্রিন্সিপাল মাওলানা এজহারুল হক (ঢাকা), ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা মোবাশ্বিরুল হক নাঈম (ভোলা), প্রিন্সিপাল ড. মাওলানা ইদ্রিস খান (ময়মনসিংহ), প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু জাফর মোঃ ছাদেক হাসান (ঢাকা), প্রিন্সিপাল ড. মাওলানা আবুবকর সিদ্দিক (বরিশাল), প্রিন্সিপাল মাওলানা মাসুদ আলম (কিশোরগঞ্জ), প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু ইউসুফ (ফরিদপু), উপাধ্যক্ষ মাওলানা আবদুর রাজ্জাক (দিনাজপুর), প্রিন্সিপাল মাওলানা আতিকুল ইসলাম (সিরাজগঞ্জ), প্রিন্সিপাল মাওলানা গাজী মো. শহীদুল হক (ঝালকাঠী), প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল এরশাদ মো. সিরাজুম মুনির (রাজবাড়ি), মাওলানা মো. আনোয়ার হোসেন (জামালপুর) প্রমুখ।