ইসলামী আক্বিদা বিশ্বাস ও মূল্যবোধের বিষয়ে কোনো আপোষ নয়: এ এম এম বাহাউদ্দীন
কার্যনির্বাহী কমিটির সভা: ভেদাভেদ ভুলে আলেম-ওলামা, দরবারগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান
২৩ ডিসেম্বর ২০২৩
মাদক, অস্ত্র, যৌনতা, লোভ-লালসার মাধ্যমে সমাজকে যেভাবে নষ্ট করা হয়েছে সেটিকে ঠিক করতে হলে আলেম-ওলামার ভূমিকা রাখার কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন দেশের মাদরাসা শিক্ষকদের সর্ববৃহৎ ও একমাত্র অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি ও দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীন। তিনি বলেন, আজকে বাচ্চাদের শিক্ষার নামে যৌনতা শেখানো হচ্ছে, যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। ইসলামের অস্তিত্ব, মুসলমানদের আকিদা বিশ্বাস, মূল ধারা, মূল বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানা হচ্ছে। আমি কি মানুষ, নাকি বানর সেটা নিয়ে কনফিউশন তৈরি করা হচ্ছে। এভাবে ছোটবেলা থেকেই ভিন্ন চিন্তা-ধারার মানুষ তৈরি করে আমাদের সমাজকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। এটি সম্ভব হয়েছে আলেম-ওলামার মধ্যে বিভেদের কারণে। জমিয়াত সভাপতি বলেন, কে কাকে ভোট দেবে সেটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই, এটা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়।
কিন্তু ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে ইসলামী সমাজ, চিন্তা-চেতনা, আক্বিদা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ ঠিক রাখতে হবে। এর সঙ্গে কোনো আপোষ নেই। এর বাইরে কোনো চিন্তা মেনে নেয়া হবে না, দেশের আলেম সমাজ সেটি মেনে নেবে না। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মহাখালিস্থ গাউসুল আজম কমপ্লেক্সে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন মাদরাসা শিক্ষকদের সর্ববৃহৎ এ সংগঠনের সভাপতি আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীন। সভা পরিচালনা করেন মহাসচিব প্রিন্সিপাল মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজী।
সভায় জমিয়াত সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, মাদরাসা শিক্ষা ও জমিয়াতের দর্শন হচ্ছে এদেশে ইসলামী সমাজ তৈরি করা। মানুষের চিন্তা-চেতনায় যাতে ইসলামী ভাবধারা থাকে সেটার জন্য কাজ করা। কিন্তু এখন যে কাজ হচ্ছে, যে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, সেটি হচ্ছে চিন্তা-চেতনায় ইসলামশূন্য করা। এর মাধ্যমে সমাজকে নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। আর এর খেসারত সকলে দিচ্ছে, ঘরে ঘরে দিচ্ছে। সরকার নিজে দিচ্ছে, নির্বাচনে নিজেরা নিজেরা মারামারি করছে, কেউ কাউকে মানছে না। মুরুব্বিদের প্রতি, পরিবারের প্রতি, নেতার প্রতি কারো প্রতি কারো শ্রদ্ধা নেই।
মুসলমানদের আক্বিদা, বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানা হচ্ছে অভিযোগ করে দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক বলেন, এখন ইসলামের অস্তিত্ব মুসলমানদের আকিদা বিশ্বাসের ব্যাপার। মূল ধারা, মূল বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানা হচ্ছে। আমি কি মানুষ, নাকি বানর সেটা নিয়ে কনফিউশন তৈরি করা হচ্ছে। এভাবে ছোটবেলা থেকেই ভিন্ন চিন্তা-ধারার মানুষ তৈরি করে আমাদের সমাজকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। মোদি যেভাবে ভারতের ক্ষমতায় এসে হাজার বছরের মুসলিম শাসনের ইতিহাস, ঐতিহ্য বিকৃত করছে, ভারতের বড় বড় শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী তারা নিজেরাই এটা বলছে। আমাদের এখানে দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর আমরা সেই ধারাটা নিয়েছি। অথচ নুরুল ইসলাম নাহিদ দুই মেয়াদে শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে আওয়ামী লীগ যেটা কল্পনাও করতে পারেনি, আলেম-ওলামার সঙ্গে সর্বোচ্চ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি বুঝেছিলেন, ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে মূল আকিদা-বিশ্বাসকে অবজ্ঞা করে কোনোকিছু করা যাবে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও সেটিই বিশ্বাস করেন বলে বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন।
তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, দীপু মনিরা বাংলাদেশে যে ধরনের সমাজ তৈরি করতে চান তারা বাংলাদেশে সেই সমাজ তৈরি করতে পারবে না, ইন শা আল্লাহ। কারণ মিথ্যা জিনিস টিকবে না। এর আগেও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে অনেকেই চেষ্টা করেছিলেন, তারা ব্যর্থ হয়েছেন। কামাল আতাতুর্ক তুরস্কে ৭০ বছরে যা করেছিলেন এখন কি তার কিছু আছে? এখন এরদোগানকে বলা হয় নব্য সুলতান। ঈমান-আক্বিদা-বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তার নেতৃত্বে হারানো সাম্রাজ্যে প্রভাব বলয় তৈরি হয়েছে তুরস্ক।
আলেম-ওলামা-দরবারগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, আলেমদের মধ্যে বিভেদ বেড়েছে, এক দরবারের সঙ্গে আরেক দরবারের যোগাযোগ নেই। হয়তো এই চলমান সঙ্কট আমাদের সকলকে একীভূত হতে সহায়তা করবে। ব্যক্তিগত লোভ-লালসায় যারা সরে যাচ্ছেন তারা যাক। মোনাফেক চিহ্নিত হওয়ার প্রয়োজন আছে। তারা চিহ্নিত না হলে আমরা এগোতে পারবো না। আমাদের সকলের এখানে দল-মত নির্বিশেষে মূল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আমাদের আপোষের কোনো সুযোগ নেই, আপোষ হবে না। আল্লাহ তা‘আলা তখনই আমাদের সহযোগিতা করবেন যখন আমরা সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসবো। এজন্য ছারছীনা, চরমোনাই, ফুলতলী, মৌকারা, ফুরফুরা, জৈনপুরসহ সকল দরবারকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। আলেমগণ যদি কথা বলতে ব্যর্থ হন, মানুষের চিন্তাধারা বুঝতে ব্যর্থ হন তাহলে অন্যরা নেতৃত্ব নিয়ে যাবে সমাজের। আলেম-ওলামা ব্যর্থ হলে কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব কোনোটাই থাকবে না। তাই লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে আলেমদের উঠতে হবে। তা না হলে সবকিছু হারাবেন।
তিনি বলেন, আমরা এগিয়ে না এলে ইসলামী চিন্তা-চেতনার সমাজ বিনির্মাণ করতে না পারলে নেতৃত্ব চলে যাবে অন্যদের হাতে। বেতন-ভাতার আন্দোলন করতে গিয়ে সরকার সুবিধা নিয়েছে। সম্পদ বৃদ্ধি ও বরকতের মালিক আল্লাহ। আমরা যদি এর পেছনে ছুটতে থাকি তাহলে অন্যরা সুযোগ নেবে। যারা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করছে। মানুষ যেটা চায় সেটা বলতে না পারলে মাহফিলগুলোতে আর মানুষ পাওয়া যাবে না। এজন্য মানুষের পাল্স বুঝতে হবে, পড়াশুনা করে, ডকুমেন্ট দিয়ে মানুষের কাছে তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। আর আলেমদের মধ্যে কিছু উচ্ছিষ্টভোগী থাকবে, কিন্তু দিন শেষে তারা অপমাণিত হয়, গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
জমিয়াত সভাপতি বলেন, একীভূত শিক্ষার বিরুদ্ধে জমিয়াত সব সময় আন্দোলন করে আসছে। এর আগে বাতিল করা হয়েছিল, আবার সেটি করা হচ্ছে। যারা সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে তাদের কারণে এমনটি হতে পারে। কিন্তু খেসারত আমাদের দিতে হবে। তবে দীপু মণি করুক আর যেই করুক সরকারের দায়িত্বশীল যারা আছেন তারা এর দায় এড়াতে পারবেন না।
তিনি বলেন, আজকে এমন কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছে, যেখানে যৌনতা নিয়ে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির বাচ্চাদের। সুড়সুড়ি দিয়ে বাচ্চাদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এভাবে সমাজকে নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। তবে আলেম-ওলামা যদি সঠিক পথে থাকেন তাহলে বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ডলার দিয়ে কোনো কাজ হবে না। আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে তাদের মতো সমাজ নির্মাণে। আর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ভারতকে। বলা হয়েছিল আফগানিস্তানের মানুষের চিন্তা-চেতনা সকল সঙ্কটের মূল। ২০ বছর পর তারা চলে গেছে, যাওয়ার সময় ভারতীয়দের জানায়ওনি। কারণ ভারত তাদের বিভ্রান্ত করেছে। মূল বিশ্বাস, মূল ধারা যদি ঠিক থাকে তাহলে যত দালাল, চাটুকার থাকুক কোন কাজ হবে না।
এসময় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আরো বক্তব্য রাখেন- জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা কবি রুহুল আমিন খান, সহ-সভাপতি প্রিন্সিপাল মাওলানা ড. কাফীল উদ্দিন সররকার সাহেলী, দফতর সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা এজহারুল হক, মানিকগঞ্জ জেলা সভাপতি প্রিন্সিপাল মাওলানা আতিকুর রহমান প্রমুখ।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন- কেন্দ্রীয় নেতা প্রিন্সিপাল ড. মাওলানা নজরুল ইসলাম আল মারুফ, প্রিন্সিপাল মাওলানা জহিরুল হক, ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা মোবাশ্বিরুল হক নাঈম, প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সাদেক হাসান, প্রিন্সিপাল মাওলানা জালাল উদ্দীন, প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু রাফে, প্রিন্সিপাল মাওলানা জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার, প্রিন্সিপাল ড. মাওলানা মহিউদ্দীন আহমদ, প্রিন্সিপাল মাওলানা রেজাউল হক, প্রিন্সিপাল মাওলানা আ ন ম বোরহান উদ্দিন, প্রিন্সিপাল মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ, প্রিন্সিপাল মাওলানা শরিফ মুহাম্মদ আবু হানিফ, প্রিন্সিপাল মাওলানা শেখ লোকমান হোসেন, প্রিন্সিপাল মাওলানা শাহ মাহমুদ ওমর জিয়াদ, প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু রায়হান ভূইয়া, প্রিন্সিপাল মাওলানা মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল মাওলানা বরকত উল্লাহ, প্রিন্সিপাল মাওলানা কে এম সাইফুল্লাহ, প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু সালেহ মোহাম্মদ তাজুল আলম, প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল জলিল মিয়া, ড. মোহাম্মদ এমরানুল হক, মো. মাকসুদুল হক, মো. মুস্তাক আহমদ, মো. সিদ্দিকুল্লাহ পাটোয়ারী, মো. মোস্তাফিজুর রহমান, মাহবুবুর রহমান ইবনে মাওলানা শামসুল হক প্রমুখ।